ঢাকার রাজনীতি বনাম দিল্লির সিদ্ধান্ত : থেমে গেল রেলপথের গতি

ঢাকার রাজনীতি বনাম দিল্লির সিদ্ধান্ত : থেমে গেল রেলপথের গতি

BDTone Desk

Published : 01:19, 21 April 2025

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে রেলপথে কানেক্টিভিটি সম্প্রসারণ শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়, বরং এটি এক প্রকার আঞ্চলিক কূটনীতির কৌশল। এই প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৮টি রাজ্যকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছিল। যাতে সংকীর্ণ ও কৌশলগতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ‘সিলিগুড়ি করিডোর’-এর ওপর নির্ভরতা কমানো যায়।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের তরফ থেকে প্রায় ৫,০০০ কোটি রুপির রেল প্রকল্প স্থগিতের ঘোষণা—যার মধ্যে আখাউড়া-আগরতলা, খুলনা-মোংলা ও ঢাকা-জয়দেবপুর প্রকল্প বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য—একটা বড় ধরনের ভূ-কৌশলিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। 

রোববার ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু বিজনেস লাইনের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

স্থগিতের কারণ: নিরাপত্তা নাকি কূটনৈতিক বার্তা?
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের ‘রেলওয়ে বোর্ড’-এর সূত্রে বলা হচ্ছে, “বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও শ্রমিক নিরাপত্তা”র বিষয়টিই প্রকল্প বন্ধের প্রধান কারণ। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি সম্ভবত এর চেয়েও গভীর কূটনৈতিক বার্তা বহন করছে।

২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচন এবং এর পরবর্তী সময়ে ভারতের ‘প্রতিক্রিয়া নিরপেক্ষতা’—বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্ব এবং বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোর বয়ান থেকে দূরে থাকা—বাংলাদেশে একটি অংশের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি করেছে। পাশাপাশি, তিস্তা প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশের ক্ষোভ, রোহিঙ্গা সংকটে ভারতের সক্রিয়তা না থাকা এবং সীমান্তে সম্প্রতি কিছু অপ্রীতিকর ঘটনার কারণে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উষ্ণতা কিছুটা কমেছে বলে ধারণা।

ভারতের বিকল্প কৌশল: ভূটান-নেপাল হয়ে উত্তর-পূর্ব সংযোগ
ভারতের রেলওয়ে বোর্ড বলেছে, তারা এখন উত্তর ভারতের বিহার ও উত্তরপ্রদেশে লাইন ডাবলিং ও কোয়াড্রপ্লিং (চারগুণ লাইন সম্প্রসারণ) প্রকল্পে মনোযোগ দিচ্ছে। এছাড়া, ভূটান ও নেপালের মধ্য দিয়ে বিকল্প সংযোগ গড়ে তোলার চিন্তা করছে—যা এক ধরনের ‘ডিপ্লোম্যাটিক ব্যালান্সিং অ্যাক্ট’ হিসেবেই দেখা যেতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, ভারত-নেপাল রেল চুক্তির আওতায় বিরাটনগর-নিউ মাল (১৯০ কিমি) এবং গলগলিয়া-ভদ্রপুর-কাজলী বাজার (১২.৫ কিমি) রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা ইতিমধ্যেই গৃহীত হয়েছে।

বাংলাদেশের জন্য বার্তা কী?
এই প্রকল্পগুলোর স্থগিতাদেশ বাংলাদেশের জন্য একাধিক মাত্রায় অস্বস্তিকর। একদিকে, ভারতের সহায়তায় গড়ে ওঠা পরিকাঠামো প্রকল্পগুলো বাংলাদেশে কর্মসংস্থান, পণ্য পরিবহন, বন্দর ব্যবস্থাপনা এবং অভ্যন্তরীণ লজিস্টিকস ব্যবস্থায় উন্নয়ন আনতে পারতো। মোংলা বন্দরকে খুলনার মাধ্যমে যুক্ত করার প্রকল্প—যেটির মাধ্যমে বাংলাদেশ নিজেই ভারতের কিছু পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে রাজস্ব অর্জন করতো—তা এখন অনিশ্চিত।

অন্যদিকে, ভারতের এই সিদ্ধান্ত ঢাকার প্রতি একটি সুস্পষ্ট বার্তা: সম্পর্ক যদি কৌশলগত স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীলতার পথে না চলে, তবে বিকল্প পথ খোলা আছে।

‘কানেক্টিভিটি’ এখন কূটনৈতিক অস্ত্র
রেলপথ, সড়কপথ বা বন্দর—এসব এখন আর শুধু উন্নয়নের প্রতীক নয়, বরং ভূ-রাজনীতির ভারসাম্য রচনার এক প্রধান মাধ্যম। ভারত এখন সেই ভারসাম্যকে পুনর্বিন্যাস করছে—বাংলাদেশের কূটনৈতিক অস্থিরতার সময়কালে নিজেকে বিকল্পপথে চালনা করার কৌশলে।

বাংলাদেশের জন্য এই বার্তা পরিষ্কার: সম্পর্কের রেলপথে গতি বজায় রাখতে হলে, স্থিতিশীলতা, স্বচ্ছতা এবং কৌশলগত সমঝোতা প্রয়োজন।

Share:
Advertisement